মঙ্গলবার, ০১ Jul ২০২৫, ০৬:০৬ পূর্বাহ্ন
সড়ক নয়, যেন মৃত্যু ফাঁদ!
খানা-খন্দে ভরা নাভারন-সাতক্ষীরা মহাসড়ক, জলাবদ্ধতায় নরকযন্ত্রণা
মনির হোসেন, বেনাপোল।
সড়কটি যেন আর সড়ক নয়, এক ভয়ঙ্কর মৃত্যু ফাঁদ। নাভারন-সাতক্ষীরা মহাসড়কের বাগআঁচড়া সাতমাইল বাজার থেকে বেলতলা আমবাজার পর্যন্ত অংশজুড়ে যেন ভয়াল বিভীষিকা। খানাখন্দে পরিপূর্ণ এ সড়কে প্রতিদিনই কেড়ে নিচ্ছে জনজীবনের স্বাভাবিকতা। ভোগান্তির যেন শেষ নেই। জলাবদ্ধতা, কর্দমাক্ত গর্ত, যানজট ও দুর্ঘটনা এখন নিত্যদিনের সঙ্গী।
তবে সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগ বলছে, বাজার এলাকায় জলাবদ্ধতার অন্যতম কারণ হচ্ছে অপরিকল্পিত দোকান ও ভবন নির্মাণ। যত্রতত্র ড্রেনেজ লাইন না থাকায় বাজার ও আশপাশের বাসাবাড়ির পানি সরাসরি রাস্তার ওপর এসে পড়ে, এতে সড়কের ব্যাপক ক্ষতি হয়। অনেক জায়গায় সড়কের চেয়ে দোকান বা মার্কেটের প্ল্যাটফর্ম উঁচু হওয়ায় বৃষ্টির পানি রাস্তাতেই জমে থাকে। অথচ এসব স্থানে পানি নিষ্কাশনের কোনো পরিকল্পনাই রাখা হয়নি।
আগামী মাসে বাজার কমিটি ও সংশ্লিষ্ট উপজেলা প্রশাসনের কাছে চিঠি পাঠানো হবে, যাতে ভবিষ্যতে দোকান-পাট ও ঘরবাড়ি নির্মাণে সঠিক ড্রেনেজ ব্যবস্থার বিষয়টি মাথায় রাখা হয়। জনগণের সহযোগিতা ছাড়া শুধু সড়ক বিভাগ একা এ সমস্যার সমাধান করতে পারবে না বলে তারা মতপ্রকাশ করেন।
সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন বাগআঁচড়া বাজারের ব্যবসায়ী ও ক্রেতারা। জিরো পয়েন্ট মোড়ে বড় বড় গর্তের কারণে বাজারে আসা মানুষজন পড়ছেন চরম বিড়ম্বনায়। বর্ষায় এই গর্তগুলোতে জমে থাকা পানি ও কাদামাটি রাস্তার চেহারাই পাল্টে দিয়েছে। দেখলে মনে হয় যেন শহরের বুকে গজিয়ে ওঠা বিশাল পুকুর!
মাত্র দুইদিনের বৃষ্টিতেই হাঁটু সমান পানি! স্থানীয়দের অভিযোগ, সড়কের এ করুণ দশায় একটি মাঝারি বৃষ্টি হলেই পুরো রাস্তজুড়ে হাঁটু সমান পানি জমে যায়। বিশেষ করে সাতমাইল থেকে বেলতলা পর্যন্ত বাজার এলাকায় কোথাও কোথাও পথচারীরা ঠিক করে বুঝতেও পারেন না, তারা হাঁটছেন গর্তে না সমতলে। দোকানপাটে যাওয়া কষ্টকর হয়ে পড়ে, কেউ কেউ কাঁধে করে শিশু বা বই-খাতা বাঁচিয়ে রাস্তা পার হন। জলাবদ্ধতায় মোটরসাইকেল, রিকশা ও ভ্যান প্রায়শই বিকল হয়ে পড়ে থাকে, সৃষ্টি হয় দীর্ঘ যানজট। বাজারের এক ব্যবসায়ী বলেন, একটু বৃষ্টি হলেই মনে হয় নদী বয়ে যাচ্ছে। মানুষ পড়ছে, পণ্য নষ্ট হচ্ছে, আমাদের জীবনই যেন থেমে যায়।
বাজারে দেখা গেছে, দীর্ঘদিন সংস্কার না হওয়ায় রাস্তার কার্পেটিং উঠে গিয়ে জেগে উঠেছে গভীর গর্ত। যশোর ও সাতক্ষীরা জেলার লাখো মানুষ চলাচলের একমাত্র ভরসা এ মহাসড়কটি এখন যান চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। স্কুল-কলেজগামী হাজারো শিক্ষার্থী, রোগী ও সাধারণ মানুষ নিত্য ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে।
বাগআঁচড়া ডা. আফিল উদ্দিন কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী তিশা খাতুন বলেন, প্রতিদিন প্রায় ২ কিমি পথ হেঁটে কলেজে যাই। আগে যেখানে ২০ মিনিটে পৌঁছাতাম, এখন সেখানে লাগে এক ঘণ্টা। ক্লাসে মনোযোগ দিতে পারি না। বিশেষ করে পরীক্ষার সময়ে সঠিক সময়ে পৌঁছানো দুঃস্বপ্নের মতো। প্রশাসনের কাছে আমাদের আবেদন এ সড়কের দিকে একটু নজর দিন।
একই কথা বললেন স্থানীয় ভ্যানচালক আয়ুব আলী মুন্সি। তিনি বলেন, জীবনের ঝুঁকি নিয়েই যাত্রী বহন করি। গর্তে পড়ে ভ্যান উল্টে প্রতিদিনই কেউ না কেউ আহত হচ্ছে। অথচ সড়ক বিভাগের কেউ নেই দেখার।
বাগআঁচড়া বাজারের ওষুধ ব্যবসায়ী জিয়াউর রহমান জানান, বাজারের মূল স্থানে গর্তে জমে থাকা পানিতে গাড়িগুলো একে অপরকে ওভারটেক করতে গিয়ে যানজট তৈরি করছে। হঠাৎ বৃষ্টি হলে রীতিমতো পানিতে ডুবে যায় পথচারীরা। বহু মোটরসাইকেল উল্টে আহত হয়েছে। ভারী ট্রাকগুলো বিকল হয়ে দীর্ঘ সময় পড়ে থাকে বাজারের মাঝখানে।
স্থানীয় যুবক জয়নাল আবেদীন বলেন, সড়ক নির্মাণে ব্যবহৃত নিম্নমানের উপকরণ এবং সংস্কারের দীর্ঘসূত্রতা এ দুরবস্থার প্রধান কারণ। মাঝে মাঝে লোক দেখানো মেরামত করা হলেও, তা এক বর্ষাতেই ধুয়ে-মুছে যায়। প্রতিবছর সাংবাদিকরা আসে, ছবি তোলে, নিউজ হয়। পরে সড়ক বিভাগ লোক দেখানো মেরামত করে দুই-এক বস্তা বালি দিয়ে গর্ত ঢেকে চলে যায়। কিছুদিনের মধ্যেই সব আগের অবস্থায় ফিরে যায়।
এ বিষয়ে যশোর সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের উপ বিভাগীয় প্রকৌশলী মাহবুব হায়দার খান বলেন, নাভারন-সাতক্ষীরা মহাসড়কের সংস্কার কাজের দরপত্র (টেন্ডার) ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে এবং ঠিকাদারও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে আগামী জুলাই মাসেই কাজ শুরু করা যাবে বলে আশা করছি।
তিনি বলেন, প্রতিটি সড়কে লম্বালম্বিভাবে ড্রেন নির্মাণ সম্ভব নয়, এটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ। আবার বিটুমিনের (রাস্তা নির্মাণে ব্যবহৃত উপাদান) বড় দুর্বলতা হলো পানি। টানা দুই-তিন দিন বৃষ্টিতে ভিজে থাকলে বিটুমিন দ্রæত ক্ষয়ে যায়। তাই সড়ক টেকসই করতে হলে শুধু মেরামত নয়, জনগণকেও ড্রেনেজ ও পানি নিষ্কাশনের ক্ষেত্রে সচেতন হতে হবে। #